মুহাম্মদ মোশারফ হোসাইন
শিক্ষার্থীঃ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের কে হেদায়াত ও দ্বীনের সুশিতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করানোর জন্য অনেক নবী -রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর সে দ্বারা শেষ হয় আমাদের প্রিয়নবী (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর মাধ্যমে। পরবর্তীতে উম্মতে মুহাম্মদীকে দ্বীনের সঠিক পথ ও মত দেখানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য আউলিয়া কিরাম প্রেরণ করেছেন।তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি)।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ১৩৩৬ হিজরী সন মোতাবেক ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জেলার সিরিকোট নামক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি একজন সৈয়্যদ। তার পিতা হলেন সৈয়্যদ আহমদ শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এবং মাতা সৈয়্যদা খাতুন। তিনি পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে রাসূল (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বংশধর। বংশ পরম্পরায় তিনি রাসূল (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর ৪০ তম বংশধর। (উইকিপিডিয়া)
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি তার পিতার তত্ত্বাবধানে ১১ বছর বয়সে কুরআন হিফয করেন। পরবর্তীতে তিনি ইলমে দ্বীনের সকল বিষয়ে তথা নাহু-সরফ,বালাগাত, মানতিক,ইলমে তাফসির,ইলমে হাদীস,ইলমে ফিকহ্ সহ বিভিন্ন বিষয়ে সমানভাবে পান্ডিত্য অর্জন করেন।এবং তিনি একজন খ্যাতিমান ক্বারীও ছিলেন। তিনি হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী কতৃক প্রতিষ্ঠিত হরিপুর দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়াতে অধ্যায়ন করেন। তিনি পাকিস্থানের বিখ্যাত মুহাদ্দিস সরদার আহমদ লায়লপুরী থেকে হাদিস এর ইলম অর্জন করেন। পরবর্তীত তিনি হরিপুর দারুল উলুম এর পরিচালক এবং অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) বাংলাদেশে আগমন করেন তার পিতা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ‘র মাধ্যমে। হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন কাদেরিয়া তরিকার একজন শায়খ। তিনি সুদূর আফ্রিকা, বার্মা বাংলাদেশ সহ অনেক দেশে শরীয়ত-তরিকত প্রচার প্রসারে সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তার ভক্ত-মুরিদানদের কে বাংলাদেশে এসে মাদ্রাসা’র জন্য জায়গা দেখতে বলেন যে, যা গ্রামও হবে না, শহরও হবে না। এমন জায়গাতেই তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশে সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া। হুজুরের ওফাতের পর থেকে হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর দায়িত্বে আসীন হন। এরই পেক্ষিতে তিনি তার পিতার সাথে বাংলাদেশে আগমন করেন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য ১৯৪২ সালে আগমনের তথ্য পাওয়া যায়।(উইকিপিডিয়া)
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) তরিকতের কার্যক্রম প্রচার-প্রসারে ছিলেন অনন্য। তিনি তার পিতা প্রখ্যাত ওলিয়ে কামেল, শায়খে তরিকত হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর মুরিদ ছিলেন। পরবর্তীতে তার পিতা হতে ১৯৫৮ সালে খিলাফত প্রাপ্ত হন। সেই সময় হতে মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত তিনি দেশ- বিদেশে সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়া তরিকার প্রচার-প্রসার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ধর্মীয় প্রচার-প্রসার কাজেও অনন্য ছিলেন। তিনি শরিয়ত,তরিকত এর কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্য অসংখ্য মাদ্রাসা,মসজিদ এবং খানকা ইত্যাদি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যা শরিয়ত -তরিকত এর কাজকে বেগবান করার অন্যতম মাধ্যম। তিনি সব সময় ভক্ত-মুরিদানদের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিতেন। তার হাতে গড়ে উঠে “কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া,ঢাকা (১৯৬৮), হালিশহর তৈয়্যবিয়া ফাযিল, চট্টগ্রাম (১৯৭৫), চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া ফাযিল,রাঙ্গুনিয়া (১৯৭৬) সহ অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান যা বর্তমানেও সত্যিকারের আলেম তৈরির মাইলফলক হয়ে দাড়িয়ে আছে।
সংস্কার কাজেও হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) অতুলনীয়। বিশ্বব্যপী বাতেল ফেরকা যখন ঈদে মিলাদুন্নবী (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বিরুদ্বে বিভ্রান্তিকর মতামত উপস্থাপন করছিলো তিনি তাদের দাঁতভাঙ্গা জওয়াব দেওয়ার জন্য প্রচলন করলেন আনুষ্ঠানিক জশনে জুলুশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তার এই সংস্কার কাজ বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও তিনি খতমে গাউসিয়া এবং পবিত্র গিয়ারবী শরীফ এর প্রচলন করেন যা ইতোপূর্বে আমাদের দেশে প্রচলন ছিল না। তার এই সংস্কার কাজসমূহ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং প্রচলিত।
সাংগঠনিক দিক থেকেও হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন সফল ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৮৬ সালে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া কে গাউছিয়া কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন। সে থেকে আজ অবদি এই সংগঠন মানুষকে শরীয়ত-তরীকতের দীক্ষা এবং মানব কল্যানে সর্বদা নিয়োজিত। বর্তমান করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে লাশ দাফন-কাফন কার্যক্রমে গাউসিয়া কমিটি’র প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বকে ফুটিয়ে তোলে। এছাড়াও তিনি সুন্নি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা কে ঈমানী ফৌজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রচার ও প্রকাশনা ক্ষেত্রেও হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর অবদান অনন্য। হুজুরের নির্দেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা,পথ -মত প্রচার প্রসারের জন্য আহলে সুন্নাতের মুখপত্র তরজুমান এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। যা ৪০ বছর যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। এছাড়াও তিনি দরুদ শরীফের অনন্য ও অতুলনীয় ৩০ পারা সম্বলিত গ্রন্থসম্ভার হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী কতৃক রচিত মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। যা বর্তমানে ১৫ পারা প্রকাশিত হয়েছে। অবশিষ্ট ১৫ পারা প্রকাশনার কাজ চলছে। এছাড়াও তিনি আরো অনেক গ্রন্থ প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। তিনি প্রচার -প্রকাশনার কাজকে বেগবান করার জন্য আনজুমান রিসার্চ সেন্টার গড়ে তোলেন। এই রিসার্চ সেন্টারের অধীনে বর্তমানে অনেক ইসলামিক বই রচনা এবং প্রকাশিত হয়েছে।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বিদ্বান,বাগ্মী,যুক্তিবিদ এবং ইসলামিক গবেষক।তিনি প্রত্যহ ফজরের নামাযের পর ভক্ত-মুরিদানদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করতেন। তার বক্তব্যে সকলে বিমহিত ও মুগ্ধ হয়ে যেতেন। অনেকে অনেক সময় মনে প্রশ্ন নিয়ে যেতেন। হুযুর তার বক্তব্যের মধ্যে ওই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতেন অথছ তারা প্রশ্ন জিঙ্গেসও করেনি। তা থেকে হুজুরের আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ পায়।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন তরিকতের পীরে কামেল।তিনি ছিলেন বেলায়েতের সম্রাট। এমনকি তিনি ছিলেন মাদারজাত (মাতৃগর্ভের) অলি। তার অসংখ্য অগনিত কারামাত বিদ্যমান। একদা তার পিতা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) যখন তার পির খাজা চৌহরভী’র নিকট যান তখন তিনি তার নিজের পৃষ্ঠদেশে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ এর আঙ্গুল মোবারক রেখে ঘর্ষন করে বলেন “ইয়ে পাক ছিজ তুম লে লো”। “পাক” এর আরবি প্রতিশব্দ হলো তৈয়্যব। আর হুযুর জন্মের পর নামও রাখা হয় তৈয়্যব।
একদা হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর আম্মাজান তাকে নিয়ে হযরত চৌহরভী’র দরবারে গেলে সেখানে তিনি শিশুসূলভ আচারনে দুধ পান করতে চাইলে হযরত খাজা চৌহরভী বললেন “তৈয়্যব তুম বড়া হো গেয়া দুধ মত পিয়ো” অর্থ্যাৎ তৈয়্যব তুম বড় হয়ে গেছো, দুধ পান করো না। তার পর থেকে তিনি আর দুধ পান করেননি।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) শৈশব থেকে তার আধ্যাত্মিক প্রতিভা বিস্তৃত হয়েছে। তিনি শৈশবে তার পিতার সাথে যখন নামায পড়ছিলেন তার পিতার নিকট আরজ করলেন ” নামায মে আফ আল্লাহ কো দেখতে হ্যায়, মুজেহ বি দেখনা হ্যায়” অর্থ্যাৎ নামাযের মধ্যে কী আল্লাহকে দেখেন? আমারও দেখা চায়। এই থেকেও হুজুরের চিন্তা ধারা প্রস্ফুটিত হয়।
একদা এক ব্যক্তি হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর নিকট এসে বললেন যদি আপনি আমার আব্বুকে হাজির করাতে পারেন আমি আপনার বায়াত গ্রহন করবো।তার পিতা মৃত। যখন ওই ব্যক্তি নামায পড়তেছিলেন যখন রুকুতে গেছেন তার পিতাকে দেখতে পেলেন। নামাজ ও পড়ছিলেন। সালাম শেষে আর দেখেন নি। সুত্রঃ (মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.)।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর কারামাত অসংখ্য ও অগনিত। তিনি সর্বদা শরিয়ত-তরিকত এর চর্চা, শিক্ষা, দীক্ষা মানুষের অন্তরে গেথে দিয়েছেন। যা আজ আবদি বিদ্যমান। তার সকল অবদান মানুষ সম্মানেরর সাথে স্মরণ করে। আনজুমান,গাউসিয়া কমিটি, জামেয়া, কাদেরিয়া ইত্যাদি তাদের অবদান।
হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ১৪১৩ হিজরী মোতাবেক ৭ জুন ১৯৯৩ সালে ৭৭ বছর বয়সে তার নিজ আবাসে ওফাত বরন করেন।তাকে হরিপুরের সিরিকোট শরীফে দাফন করা হয়।
সর্বোপরি হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন মহান আলেম,হাফেয,ক্বারী,মহান সংস্কারক এবং শরীয়ত -তরিকতের প্রতি মানুষকে দিশা দানকারী। হুজুরের সকল কার্যক্রমকে আরো বেগবান এবং প্রসারিত করার জন্য হুজুরের প্রিয় সাহেবজাদাহ হযরত সৈয়্যদ তাহের শাহ (মু.জি.আ) এবং সৈয়্যদ ছাবের শাহ (মু.জি.আ) সিলসিলার দায়িত্ব ও অন্যান্ন সকল দায়িত্ব প্রদান করেন যা আজ অবদি চলমান। আল্লাহ হুজুরের ফয়েজ ও বরকত আমাদের জন্য জারি করুন।আমিন।
অনেক সুন্দর ও তথ্যবহুল হয়েছে।
LikeLike