আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র জীবন ও কর্ম

মুহাম্মদ মোশারফ হোসাইন

শিক্ষার্থীঃ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া

মহান আল্লাহ তা’য়ালা মানবজাতিকে হেদায়েতের জন্য অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর সে দ্বারা শেষ হয় আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মাধ্যমে। পরবর্তীত আল্লাহ তা’য়ালা মানবজাতিকে হেদায়েতের উপর অটল রাখা ও দ্বীনের সকল বিষয়কে সঠিকভাবে অনুধাবন করানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য জ্ঞানী ও পন্ডিতদেরকে প্রেরন করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন দ্বীনের উজ্জ্বল প্রদীপ হলেন ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)।

জন্ম বৃত্তান্ত

জ্ঞানের মহান বিশ্বকোষ, দ্বীনের উজ্জ্বল প্রদীপ, আশেকে মুস্তফা,রাসূলে পাকের মো’জেজা সমূহের অন্যতম একটি মো’জেজা, মুজাদ্দেদে দ্বীন ও মিল্লাত ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ভারতের ব্রেলী শরীফের জহীরা নামক গ্রামে ১০ই শাওয়াল ১২৭২ হিজরী,১৪জুন ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দ মোতাবেক রোজ-শনিবার জোহরেরর সময়ে এব সম্ভ্রান্ত বংশে ইমাম আর্বিভূত হন।যা তিনি প্রসিদ্ব আবজাদ হিসাবানুযায়ী পবিত্র কুরআনের সূরা মুজাদালাহ,আয়াত নং-২২ থেকে তার জন্মসাল জ্ঞাপন করেছেন। তার পিতা ছিলেন যুগশ্রেষ্ট মুহাদ্দিস আল্লাম নক্বী আলী খান (রহমতুল্লাহি আলাইহি)।

ইমামের শিক্ষা জীবন

ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) শৈশব থেকেই অত্যন্ত প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি মাত্র চার বছর বয়সে পবিত্র কুরআনের নাজেরা পাঠ শেষ করেন। পরবর্তীতে তার পিতার বন্ধু মাওলানা গোলাম কাদের বেগ’র নিকট তিনি ইলমে দ্বীনের প্রাথমিক জ্ঞান নাহু,সরফ, উর্দু,ফার্সী ও আরবী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি তার পিতা যুগশ্রেষ্ট ফকিহ্ আল্লামা নক্বী আলী খান এর নিকট ইলমে দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় তথা উলুমে হাদীস, উলুমে ফিকহ্, উলুমে তাফসীর, বালাগাত, মানতিক সহ সকল দ্বীনি বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন করেন। এমনকি তিনি গনিতশাস্ত্র, দর্শনশাস্ত্রে ও ভূতপত্তি অর্জন করেন। তিনি মাত্র ১৩ বৎসর ১০ মাস ৫দিনের মধ্যে একাডেমিক শিক্ষা শেষ করে দস্তারে ফযীলত হাসেল করেন। পরবর্তীতে তিনি তার পীর সৈয়্যদ আলে রাসূল মারেহারভী’র নিকট শরীয়ত ও তরিক্বতের বিশেষ দীক্ষা লাভ করেন।

ইমামের শৈশবের অসাধারন প্রতিভা

শৈশবকালেও ইমামের অসাধারন প্রতিভার বিকাশ ঘটে। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি জনসম্মুখে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মিলাদ প্রসঙ্গে “দু” ঘন্টা নূরানী তাকরীর করেন। যখন ৮ বছর বয়সে উপনীত হন তিনি ইলমে দ্বীনের প্রসিদ্ব কিতাব “হেদায়াতুন নাহু” এর আরবী ভাষায় আলোডনসৃষ্টিকারী ব্যখ্যা গ্রন্থ লিখেন। যা ইমামের জ্ঞানের গভীরতা জানান দেয়। এমনকি ইমামের বয়স যখন ৮ বছর তিনি ইলমুল ফরায়েজ সম্পর্কিত জটিল একটি মাসআলা সমাধান করেন যা তার পিতাকে মুগ্ধ করে। আ’লা হযরত যেদিনে দস্তারে ফযীলত গ্রহন করেন সেদিন রাদাআত তথা স্তন্যপান সম্পর্কিত জটিল মাসআলা’র সমাধান দেওয়ার মাধ্যমে ইমামের জ্ঞানের প্রখরতা সকলের নিকট অনুধাবিত হয়।

বায়’য়াত ও খেলাফত

আ’লা হযরত যেমনিভাবে শরীয়তের আলেম ছিলেন তেমনিভাবে তরিকতের শায়খও ছিলেন। একদা তিনি তার পিতা ও অন্য একজন সহ “মারেহেরা শরীফে তাশরীফ নিলেন এবং সেখানকার সাজ্জাদানশীন হযরত সৈয়্যদেনা শাহ আলে রাসূর মারেহারভীর সাথে সাক্ষাত হলো। তিনি আ’লা হযরতকে দেখে বলেন আসুন,আপনার অপেক্ষায় রয়েছি। অতঃপর তিনি ও তার পিতা আলে রাসূলের নিকট বায়’য়াত গ্রহন করেন। ঔই দিনেই আলে রাসূল আ’লা হযরতকে খিলাফত প্রদান করেন। এছাড়াও

জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আ’লা হযরত

পরওয়ানায়ে শাময়ে রিসালত ইমাম আহমদ রেযা খান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র। যা তিনি রাসূলে পাকের করমে অর্জন করেছেন। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় সকল বিষয়ে সমানভাবে পারদর্শি ছিলেন। বর্তমান গবেষনা মতে তিনি প্রায় ১০৫ টি বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জনের প্রমান পাওয়া যায়। এবং তিনি ৫৫ টি বিষয়ের উপর বিভিন্ন ভাষায় কিতাব রচনা করেন। যা আজ গোটা মুসলিম উম্মার জন্য আলোকবার্তিতা স্বরুপ ধারন করেছে। ইমাম এমন অনেক বিষয়ে কিতাব রচনা করেছেন যা ইতোঃপূর্বে রচিত হয়নি। ইমামের ৫৫ বিষয়সমূহ ইলমুল কুরআন, ইলমুল হাদিস,উসূলে হাদিস,ফিকাহ্,উসূলে ফিকাহ্,তর্কশাস্ত্র,তাফসির,ইলমে আকাইদ,ইলমে মায়ানী, বাদী,বায়ান,ইলমে নাহু,সরফ,মানতিক্ব,জদল মহায্যর, ইলমে তাবসীর,হাইয়্যাত,হিসাব,হিন্দাসা,মুনাযারা,ফালসাফা,ক্বিরাত,তাজবীদ,তাসাউফ,সুলূক,আখলাক, আসমায়ে রিজাল, সিয়ার,তারিখ,লুগাত,ইলমুল আদাব এসব গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন।এমনকি তিনি এ্যারিসমাতীক্বী,যবর ও মোক্বাবেলাহ,হিসাবে সিত্তানী,লগারিদম,আকর,যীজাত,মুসাল্লাসে কুরভী,হাইয়াতে জাদীদাহ,মুরাব্বাআত,ইলমে জুফর,ইলমে নুজুম সহ আরো অনেক বিষয়ে পারদর্শি ছিলেন।

লিখনীতে আ’লা হযরতের অবদান

আব্দুল মোস্তফা ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন লিখনীর দিক থেকে অতুলনীয়। তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় ৫৫ টি বিষয়ের উপর ১৪০০ কিতাব রচনা করেছেন। তিনি প্রতিটি বিষয়ের উপর তার কলম ধরেছেন। তাইতো অনেক মনীষীর মতে আইম্মায়ে মুতায়াখ্খেরিনদের মধ্যে আ’লা হযরতের সমতুল্য হওয়ার যোগ্যতা ইমাম সুয়ূতি ব্যতিত অন্য কারো নেই। যেই বিষয়ে কলম ধরেছেন মানুষ তাতে অবাক হয়েছে। তিনি পবিত্র কুরআনের সর্বশ্রেষ্ট অনুবাদ,অসংখ ব্যাখ্যা, হাশিয়াহ,হাদীস গ্রন্থ,হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ, আকাইদ,ইলমে কালাম, ইলমে ফিকহ তাসাউফ, তারিখ, সিয়ার, আদাব,লোগারসাম,ফালসাফা,মানতিক সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর কলম ধরে শরিয়তকে জীবিত করেছেন। তিনি ফিকহে হানাফি উপর ৩০ খন্ড সম্বলিত ফতোয়াগ্রন্থ “ফতোয়ায়ে রেজভীয়্যাহ “ লিখেন যাতে প্রায় সকল বিষয়ের সমাধান রয়েছে। ইমামের সকল গ্রন্থ আজ বিশ্বব্যাপী অনুসরনীয় এবং শরীয়ত চর্চার বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

না’ত সাহিত্যে আ’লা হযরত

আ’লা হযরত আযিমুল বারকাত ইমাম আহমদ রেযা খান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন একজন প্রকৃত আশেকে রাসুল। তিনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর মুহাব্বত তথা ভালোবাসার গুরুত্ব ও আবশ্যকতা তার কাব্য, লেখনীতে তুলে ধরেছেন।তিনি রাসূলের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এক অতুলনীয়,অমুল্য না’ত তথা প্রশংসা কাব্যগগ্রন্থ লিখেন। আর তা হলো “হাদায়েকে বখশিশ“।এই না’ত গ্রন্থে সকল না’ত রাসূলের গুনকীর্তন, প্রশংসা নিয়েই পরিপূর্ণ। যাতে ইমাম সকল না’তে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অর্থ,মমার্থ ও ব্যখ্যার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। যেই না’ত গ্রন্থের ব্যাখ্যাও ২৫ খন্ডে বের হয়েছে। আজ ইমামের এই না’ত গ্রন্থ আশেকে রাসূলের অন্তরের খোরাকে পরিনত হয়েছে।

ঈমান-আক্বিদা রক্ষায় আ’লা হযরত

ইমামের সময়ে তৎকালীন ভারতবর্ষে অনেক নামধারি মুসলমান সরলমনা মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদা কে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেখেছিল। তারা মুসলমানদের মনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রতি মন্দ আক্বিদা পোষন করানোর জন্য অনেক ভ্রান্ত আক্বিদা প্রচার করেন। যা কখনো শরিয়ত সম্মত আক্বিদা নয়। তারা রাসূলের জ্ঞান নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, রাসুলের খেয়াল অন্তরে লালন করা শিরিক, আল্লাহ মিথ্যা বলতে পারেন, রাসূলের নিকট কোনো ক্ষমতা নেই, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইলমে গায়েবের ধারক নন সহ আরো অনেক ভ্রান্ত আক্বিদা প্রচার করেন। আ’লা হযরত তাদের সকল ভ্রান্ত আক্বিদার বিরুদ্বে কলম ধরে সঠিক আক্বিদা মানুষের নিকট তুলে ধরেন। তিনি তাদের এইসব ভ্রান্ত আক্বিদার দাতভাঙ্গা জবাব দিতে “আল মুতামাদুল মুস্তানাদ,আদদৌলাতুল মাক্কিয়া,আল মনিয়েমুল মুকিম, মুনিরুল আইনান,আল কাওকাবাতুস শিহাবিয়া,আল ফারকুল ওয়াজিস” সহ অসংখ্য কিতাব রচনা করে তাদের জবাব দেন। এমনকি তাদের সকল ভ্রান্ত আক্বিদাকে কেন্দ্র করে আরবের অনেক আলেমের মতামত নিয়ে তিনি তাদেরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে উম্মতে মুসলিমাকে গোস্তাখানে রাসূল থেকে ঈমান-আক্বিদা সংরক্ষন করেন।

সমাজ সংস্কারে আ’লা হযরত

আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র অবদান সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে। তিনি সমাজে অনেক সংস্কার করেছেন এবং সমাজ থেকে অনেক কুসংস্কার দুরিভূত করেছেন। তিনি সমাজের মানুষকে আল্লাহ তা’য়ালা কতৃক ফরজ ইবাদতসমূহ করার এবং রাসূলের সুন্নাতসমূহ করার প্রতি সর্বদা তাগিদ দিতেন। আবার সমাজের অনেকে ফরজ ব্যতিত মুস্তাহাব ও নফলকে গুরুত্ব দিলে তিনি তাদের এগুলো শরিয়তের দৃষ্টিতে অগ্রহনযোগ্য মনে করেন। সমাজের অনেকে আউলিয়া কেরামের মাজারে যেতেন। কিন্তু অনেকে মাজারে গিয়ে সিজদা করত। তিনি আল্লাহ তায়ালাকে ব্যতিত অন্য কাউকে তাজিমী সিজদা করাকে হারাম বলেছেন। এমনকি এটি হারাম হওয়ার ব্যাপারে তিনি একটি কিতাবও রচনা করেন।আর তা হলো “আযযুবদাতুল যাকিয়্যাজ ফি তাহরিমে সুজুদিত তাহিয়্যাহ”। এভাবে মুসলিম সমাজের ছেলে মেয়েরা তাদের ঘরে বিভিন্ন জীব-জন্তুর ছবি ঘরে টাঙ্গিয়ে রাখা এবং মাটির কিম্বা প্লাষ্টিকের মূর্তি, পুতুল ইত্যাদি ঘরে সাজিয়ে রাখে। আ’লা হযরত এর তীব্র বিরোধিতা ও নাজায়েয বলেন। এমনকি দেখা যায় আমদের সমাজের মহিলারা মাজার শরীফে গমন করেন এবং অনেকে পর্দাহীন যেতেন। আ’লা হযরত এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন এবং তিনি বলেন যে মহিলারা বের হয় তাদের উপর আল্লাহর, ফেরেশতা এমনকি কবরবাসীরা লানত দেন। তিনি এ বিষয়ে একটি কিতাবও লেখেন। তা হলো “জামানুল নুর ফি নাহিয়িন আন যিয়ারাতিল কুবুর”। এভাবে সমাজে ছেলেরা বিভিন্ন উপলক্ষে আতশবাজী,ফটকা বাজী ফুটায়। আ’লা হযরত উহাকে হারাম বলেছেন। এভাবে আ’লা হযরত সমাজ থেকে অনেক কুসরংস্কার দূর করেন।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আ’লা হযরত

ইমাম আহমদ রেযা খান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) রাজনৈতিক ভাবেও একজন সফল ব্যক্তিত্ব। তার রাজনৈতিক সকল চিন্তাধারা কুরআন হাদীসের মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কোনো সময় অন্যায়ের নিকট মাথা নত করেন নি। তিনি হিন্দুদের রাজনৈতিক সকল কলাকৌশল বুঝছিলেন। গান্ধী ও তার শিষ্যরা চেয়েছিল মুসলমানদেরকে ব্যবহার করে ইংরেজদের তাড়িয়ে দিয়ে তারাই একচচ্ছ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। আ’লা হযরত তাদের এই ফাঁদ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য “দ্বি-জাতি তত্ত্ব” প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন। অবশ্য এ দ্বি-জাতি তত্ত্ব তিনি ১৮৯৭ ঈসায়ী পাটনা সুন্নি কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘোষনা দেন। তিনি ঘোষনা দেন হিন্দু তথা যে কোন কাফের শক্তির সাথে মুসলমান কখনো এক হতে পারে না। তিনি “অসহযোগ আন্দোলনে” গান্ধীর কূটনীতিক চালের মুখোস উম্মোচন ও সে সময়ে বিভ্রান্ত মুসলিম রাজনীতিকদের হিন্দু -মুসলিম ঐক্যের কুফল তুলে ধরে ভীষন অসুস্থ অবস্থায় “আল মুহাজ্জাতিল মু’তামিনাহ ফি আয়াতিল মুমতাহিনা ” নামক কিতাব রচনা করেন।এই কিতাব টি মুসলমানদের প্রথম স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্বি-জাতি তত্ত্বের লিখিত দলিল। যার অনেক পরে তা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ধারনায় আসে।এভাবে আ’লা হযরত রাজনৈতিক ভাবে অনেক অবদান রাখেন। তিনি আরো অন্যান্ন কিতাব রচনা করেন যা মুসরমানদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তিনি লেখে যান “আন নাফসুল ফিকরি ফি কোরবানীর বাকরি “ যা তিনি হিন্দুস্থানে গাভী জবেহ নিষিদ্ব করায় এর প্রতিবাদে লেখেন। এভাবে তিনি “এনামুল এনাম বিয়ান্না হিন্দুস্থান দারুল ইসলাম, তাদবীরি ফালাহ ওয়ানাজাত ওয়া ইছলাহ, দাওয়ামুল আরশি ফি আইম্মাতি কুরাইশি “ সহ আরো কিতাব রচনা করে রাজনৈতিক আন্দোলন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।

মুজাদ্দেদ তথা সংস্কারক হিসেবে আ’লা হযরত

মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হেদায়েত ও দ্বীনের সংস্কারের জন্য প্রতি শতকে একজন সংস্কারক প্রেরন করেন। যা পবিত্র হাদিসে পাকে বর্ণিত আছে। মুজাদ্দিদের সকল গুণাবলি আ’লা হযরতের নিকট বিদ্যমান। যিনি মুজাদ্দেদ হবেন তিনি পরিপূর্ণ দ্বীনের বাহ্যিক ও আধ্যাতিক জ্ঞানের আলোম হবেন। সুন্নাতের সাহায্যকারী ও বিদায়াত, কুসংস্কার দূর করবেন। যা আ’লা হযরতের মধ্যে পরিপূর্নরুপে বিদ্যমান। তিনি সহস্রাধিক কিতাব লেখে তার জ্ঞান ও সংস্কারের সকল প্রমান রেখেছেন। তিনি সমাজ থেকে সকল কুসংস্কার,রাষ্ট্রের প্রতি সকল দায়িত্ব পালন এবং দ্বীনের সঠিক রুপরেখা উম্মতে মুসলিমার নিকট তুলে ধরেন। তার তাজদীদে কর্ম সকল স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যই আরব-আজমের সকলে আ’লা হযরতকে একবাক্যে মুজাদ্দেদ তথা সংস্কারক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। তিনিই হলেন শতাব্দীর ধারাবাহিকতায় চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দেদ।

ব্রিটিশ বিরোধি হিসেবে আ’লা হযরত

আ’লা হযরত সর্বদা ব্রিটিশদের বিরোধি ছিলেন।তিনি তাদের সরকার, বিচার বিভিগ সকল বিষয়ের প্রতি তীব্র বিরোধিতা করেন। ইংরেজরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করায় তিনি বলেন “হে ঘুমন্ত! জেগে ওঠো, চোরেরাই পাহারা দিচ্ছে”। তিনি তাদের বিচারালয়ে বিচারের শরনাপন্ন হওয়াকে অর্থনৈতিক অপচয় বলে ঘোষনা দেন। তিনি ব্রিটিশদের জন্য “সরকার “শব্দ ব্যবহার করাকে প্রয়োজনবোধ মনে করতেন না। তিনি ইংরেজ বিচারালয়কে আদালত ও বিচারককে “আদেল” বলা নিষিদ্ব। করেন। শুধু তাই নয় বিচারককে “আদেল” বলে বিশ্বাস করা কুফুরি ফতোয়া দেন। ইমামের নামে যখন মামলা করা হয় তখন তিনি বলেন আহমদ রেযা না,আহমদ রেযার জুতাও ইংরেজদের কোর্টে যাবে না। এমনকি তিনি চিঠির খামে ইংরেজ রাণীর ছবি উল্টো লাগিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধদিতা করেন। এভাবে আ’লা হযরত ব্রিটিশদের সর্বদা বিরোধিতা করে যান।

আ’লা হযরতের ওফাত শরীফ

ইমাম আহমদ রেযা খান ফাযেলে বেরলভী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মৃত্যুর পূর্বে তিনি অছিয়ত নামা লেখালেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন।দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পূর্বে যে সমস্ত দোয়া পাঠ করা সুন্নাত তিনি সবগুলো পরিপূর্ণভাবে পড়লেন। অতঃপর ২৫শে সফর ১৩৪০হিজরী মোতাবেক ২৮ অক্টোবর ১৯২১ সালে জুমা মোবারকের দিনে ঠিক ২টা ৩৮ মিনিটে দুনিয়া ত্যাগ করে রাসূলের দীদারে সাড়া দিলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজেউন)। ইমামের গোসল ও দাফন শরীফে সকল ওলামায়ে কেরাম অংশগ্রহন করেন। ইমামের জানাযা সম্পন্ন করেন শাহজাদায়ে আ’লা হযরত মুফতিয়ে আজম মাওলানা আমজাদ আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) পড়ান।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর জীবন ও কর্ম

মুহাম্মদ মোশারফ হোসাইন

শিক্ষার্থীঃ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া

আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের কে হেদায়াত ও দ্বীনের সুশিতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করানোর জন্য অনেক নবী -রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর সে দ্বারা শেষ হয় আমাদের প্রিয়নবী (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর মাধ্যমে। পরবর্তীতে উম্মতে মুহাম্মদীকে দ্বীনের সঠিক পথ ও মত দেখানোর জন্য যুগে যুগে অসংখ্য আউলিয়া কিরাম প্রেরণ করেছেন।তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি)।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ১৩৩৬ হিজরী সন মোতাবেক ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জেলার সিরিকোট নামক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তিনি একজন সৈয়্যদ। তার পিতা হলেন সৈয়্যদ আহমদ শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এবং মাতা সৈয়্যদা খাতুন। তিনি পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে রাসূল (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বংশধর। বংশ পরম্পরায় তিনি রাসূল (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর ৪০ তম বংশধর। (উইকিপিডিয়া)

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত প্রখর মেধার অধিকারী ছিলেন। তিনি তার পিতার তত্ত্বাবধানে ১১ বছর বয়সে কুরআন হিফয করেন। পরবর্তীতে তিনি ইলমে দ্বীনের সকল বিষয়ে তথা নাহু-সরফ,বালাগাত, মানতিক,ইলমে তাফসির,ইলমে হাদীস,ইলমে ফিকহ্ সহ বিভিন্ন বিষয়ে সমানভাবে পান্ডিত্য অর্জন করেন।এবং তিনি একজন খ্যাতিমান ক্বারীও ছিলেন। তিনি হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী কতৃক প্রতিষ্ঠিত হরিপুর দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়াতে অধ্যায়ন করেন। তিনি পাকিস্থানের বিখ্যাত মুহাদ্দিস সরদার আহমদ লায়লপুরী থেকে হাদিস এর ইলম অর্জন করেন। পরবর্তীত তিনি হরিপুর দারুল উলুম এর পরিচালক এবং অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) বাংলাদেশে আগমন করেন তার পিতা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ‘র মাধ্যমে। হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন কাদেরিয়া তরিকার একজন শায়খ। তিনি সুদূর আফ্রিকা, বার্মা বাংলাদেশ সহ অনেক দেশে শরীয়ত-তরিকত প্রচার প্রসারে সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন। তিনি তার ভক্ত-মুরিদানদের কে বাংলাদেশে এসে মাদ্রাসা’র জন্য জায়গা দেখতে বলেন যে, যা গ্রামও হবে না, শহরও হবে না। এমন জায়গাতেই তিনি গড়ে তোলেন বাংলাদেশে সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া। হুজুরের ওফাতের পর থেকে হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর দায়িত্বে আসীন হন। এরই পেক্ষিতে তিনি তার পিতার সাথে বাংলাদেশে আগমন করেন ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য ১৯৪২ সালে আগমনের তথ্য পাওয়া যায়।(উইকিপিডিয়া)

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) তরিকতের কার্যক্রম প্রচার-প্রসারে ছিলেন অনন্য। তিনি তার পিতা প্রখ্যাত ওলিয়ে কামেল, শায়খে তরিকত হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর মুরিদ ছিলেন। পরবর্তীতে তার পিতা হতে ১৯৫৮ সালে খিলাফত প্রাপ্ত হন। সেই সময় হতে মৃত্যু পূর্ব পর্যন্ত তিনি দেশ- বিদেশে সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলিয়া তরিকার প্রচার-প্রসার কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ধর্মীয় প্রচার-প্রসার কাজেও অনন্য ছিলেন। তিনি শরিয়ত,তরিকত এর কার্যক্রমকে বেগবান করার জন্য অসংখ্য মাদ্রাসা,মসজিদ এবং খানকা ইত্যাদি দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যা শরিয়ত -তরিকত এর কাজকে বেগবান করার অন্যতম মাধ্যম। তিনি সব সময় ভক্ত-মুরিদানদের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিতেন। তার হাতে গড়ে উঠে “কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া,ঢাকা (১৯৬৮), হালিশহর তৈয়্যবিয়া ফাযিল, চট্টগ্রাম (১৯৭৫), চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া ফাযিল,রাঙ্গুনিয়া (১৯৭৬) সহ অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান যা বর্তমানেও সত্যিকারের আলেম তৈরির মাইলফলক হয়ে দাড়িয়ে আছে।

সংস্কার কাজেও হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) অতুলনীয়। বিশ্বব্যপী বাতেল ফেরকা যখন ঈদে মিলাদুন্নবী (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বিরুদ্বে বিভ্রান্তিকর মতামত উপস্থাপন করছিলো তিনি তাদের দাঁতভাঙ্গা জওয়াব দেওয়ার জন্য প্রচলন করলেন আনুষ্ঠানিক জশনে জুলুশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) যা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তার এই সংস্কার কাজ বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও তিনি খতমে গাউসিয়া এবং পবিত্র গিয়ারবী শরীফ এর প্রচলন করেন যা ইতোপূর্বে আমাদের দেশে প্রচলন ছিল না। তার এই সংস্কার কাজসমূহ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং প্রচলিত।

সাংগঠনিক দিক থেকেও হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন সফল ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৯৮৬ সালে আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া কে গাউছিয়া কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেন। সে থেকে আজ অবদি এই সংগঠন মানুষকে শরীয়ত-তরীকতের দীক্ষা এবং মানব কল্যানে সর্বদা নিয়োজিত। বর্তমান করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে লাশ দাফন-কাফন কার্যক্রমে গাউসিয়া কমিটি’র প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বকে ফুটিয়ে তোলে। এছাড়াও তিনি সুন্নি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা কে ঈমানী ফৌজ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

প্রচার ও প্রকাশনা ক্ষেত্রেও হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর অবদান অনন্য। হুজুরের নির্দেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা,পথ -মত প্রচার প্রসারের জন্য আহলে সুন্নাতের মুখপত্র তরজুমান এ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। যা ৪০ বছর যাবৎ প্রকাশিত হয়ে আসছে। এছাড়াও তিনি দরুদ শরীফের অনন্য ও অতুলনীয় ৩০ পারা সম্বলিত গ্রন্থসম্ভার হযরত খাজা আব্দুর রহমান চৌহরভী কতৃক রচিত মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল (সালল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) এর বাংলা অনুবাদ করে প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। যা বর্তমানে ১৫ পারা প্রকাশিত হয়েছে। অবশিষ্ট ১৫ পারা প্রকাশনার কাজ চলছে। এছাড়াও তিনি আরো অনেক গ্রন্থ প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। তিনি প্রচার -প্রকাশনার কাজকে বেগবান করার জন্য আনজুমান রিসার্চ সেন্টার গড়ে তোলেন। এই রিসার্চ সেন্টারের অধীনে বর্তমানে অনেক ইসলামিক বই রচনা এবং প্রকাশিত হয়েছে।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন শ্রেষ্ঠ বিদ্বান,বাগ্মী,যুক্তিবিদ এবং ইসলামিক গবেষক।তিনি প্রত্যহ ফজরের নামাযের পর ভক্ত-মুরিদানদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করতেন। তার বক্তব্যে সকলে বিমহিত ও মুগ্ধ হয়ে যেতেন। অনেকে অনেক সময় মনে প্রশ্ন নিয়ে যেতেন। হুযুর তার বক্তব্যের মধ্যে ওই সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতেন অথছ তারা প্রশ্ন জিঙ্গেসও করেনি। তা থেকে হুজুরের আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ পায়।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন তরিকতের পীরে কামেল।তিনি ছিলেন বেলায়েতের সম্রাট। এমনকি তিনি ছিলেন মাদারজাত (মাতৃগর্ভের) অলি। তার অসংখ্য অগনিত কারামাত বিদ্যমান। একদা তার পিতা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) যখন তার পির খাজা চৌহরভী’র নিকট যান তখন তিনি তার নিজের পৃষ্ঠদেশে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ এর আঙ্গুল মোবারক রেখে ঘর্ষন করে বলেন “ইয়ে পাক ছিজ তুম লে লো”। “পাক” এর আরবি প্রতিশব্দ হলো তৈয়্যব। আর হুযুর জন্মের পর নামও রাখা হয় তৈয়্যব।

একদা হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর আম্মাজান তাকে নিয়ে হযরত চৌহরভী’র দরবারে গেলে সেখানে তিনি শিশুসূলভ আচারনে দুধ পান করতে চাইলে হযরত খাজা চৌহরভী বললেন “তৈয়্যব তুম বড়া হো গেয়া দুধ মত পিয়ো” অর্থ্যাৎ তৈয়্যব তুম বড় হয়ে গেছো, দুধ পান করো না। তার পর থেকে তিনি আর দুধ পান করেননি।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) শৈশব থেকে তার আধ্যাত্মিক প্রতিভা বিস্তৃত হয়েছে। তিনি শৈশবে তার পিতার সাথে যখন নামায পড়ছিলেন তার পিতার নিকট আরজ করলেন ” নামায মে আফ আল্লাহ কো দেখতে হ্যায়, মুজেহ বি দেখনা হ্যায়” অর্থ্যাৎ নামাযের মধ্যে কী আল্লাহকে দেখেন? আমারও দেখা চায়। এই থেকেও হুজুরের চিন্তা ধারা প্রস্ফুটিত হয়।

একদা এক ব্যক্তি হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর নিকট এসে বললেন যদি আপনি আমার আব্বুকে হাজির করাতে পারেন আমি আপনার বায়াত গ্রহন করবো।তার পিতা মৃত। যখন ওই ব্যক্তি নামায পড়তেছিলেন যখন রুকুতে গেছেন তার পিতাকে দেখতে পেলেন। নামাজ ও পড়ছিলেন। সালাম শেষে আর দেখেন নি। সুত্রঃ (মুফতি ওবাইদুল হক নঈমী (রহ.)।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) এর কারামাত অসংখ্য ও অগনিত। তিনি সর্বদা শরিয়ত-তরিকত এর চর্চা, শিক্ষা, দীক্ষা মানুষের অন্তরে গেথে দিয়েছেন। যা আজ আবদি বিদ্যমান। তার সকল অবদান মানুষ সম্মানেরর সাথে স্মরণ করে। আনজুমান,গাউসিয়া কমিটি, জামেয়া, কাদেরিয়া ইত্যাদি তাদের অবদান।

হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ১৪১৩ হিজরী মোতাবেক ৭ জুন ১৯৯৩ সালে ৭৭ বছর বয়সে তার নিজ আবাসে ওফাত বরন করেন।তাকে হরিপুরের সিরিকোট শরীফে দাফন করা হয়।

সর্বোপরি হযরত তৈয়্যব শাহ (রহমতুল্লাহি আলায়হি) ছিলেন একজন মহান আলেম,হাফেয,ক্বারী,মহান সংস্কারক এবং শরীয়ত -তরিকতের প্রতি মানুষকে দিশা দানকারী। হুজুরের সকল কার্যক্রমকে আরো বেগবান এবং প্রসারিত করার জন্য হুজুরের প্রিয় সাহেবজাদাহ হযরত সৈয়্যদ তাহের শাহ (মু.জি.আ) এবং সৈয়্যদ ছাবের শাহ (মু.জি.আ) সিলসিলার দায়িত্ব ও অন্যান্ন সকল দায়িত্ব প্রদান করেন যা আজ অবদি চলমান। আল্লাহ হুজুরের ফয়েজ ও বরকত আমাদের জন্য জারি করুন।আমিন।

দোয়া’র গুরুত্ব এবং দোয়া’র সময় হাত উত্তোলন প্রসঙ্গে

মুহাম্মদ মোশারফ হোসাইন

সম্মানিত পাঠকবৃন্দ,সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ টি পড়ার জন্য। আমাদের আলোচ্য বিষয় হলো দোয়া’র গুরুত্ব এবং কিভাবে দোয়া করতে হবে অথ্যাৎ দোয়ার আদব নিয়ে।

দোয়া’র গুরুত্ব

মহান আল্লাহর দরবারে বান্দা দোয়া করা আবশ্যক।কারন বান্দার চাওয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তার নেয়ামত প্রদান করে থাকেন। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি দোয়া করা। দোয়া’র শাব্দিক অর্থ হলো ডাকা, আহ্বান করা, প্রার্থনা করা, কোন কিছু চাওয়া। পরিভাষায় আল্লাহর নিকট বিনয়ের সাথে কোন কিছু প্রার্থনা করাকে দোয়া বলা হয়। কখনো যিকরকেও দোয়া বলা হয়। এই দোয়া আল্লাহ তায়ালা নিকট অত্যন্ত প্রিয়। তাই আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে দোয়া করার নির্দেশ দিয়ে বলেন ْوَقَالَ رَبُّكُمْ اُدْعُوْنِيْ اَسْتَجِب لَكُمْ অর্থ্যাৎ তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমার নিকট দোয়া কর,আমি তোমাদের দোয়া কবুল করবো।সুতারাং মুমিন ব্যক্তির উচিত আল্লাহর নিকট দোয়া করা এবং দোয়া কবুলের প্রতি দৃড় বিশ্বাস রাখা।

আল্লাহ তায়ালা অন্যত্র বলেন ْوَاِذَا سَاَلَكَ عِبَادِي عَنِّيْ فَاِنِّيْ قَرِيْبٌ اُجِيْبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ اِذَا دَعَان فَلْيَسْتَجِيْبُوْا لِيْ وَلْيُؤمِنُوْا بِيْ لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُوْن অর্থ্যাৎ আমার বান্দারা যখন আপনার নিকট আমার সম্পর্কে জিঙ্গাসা করে, বস্তুত আমি তাদের সন্নিকটে,যখন তারা দোয়া করে আমি তাদের দোয়া কবুল করে নিই।সুতারাং বুঝা যায়, আল্লাহর নিকট বান্দা দোয়া করা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন اُدْعُوْهُ خَوْفًا وَطَمْعًا اِنَّ رَحْمَتَ اللّٰهِ قَرِيْبٌ مِنَ الْمُحْسِنِيْن তোমরা আল্লাহকে ডাক ভয় ও আশা নিয়ে। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার রহমত সৎলোকদের সন্নিকটে।অন্যত্র আরো বলেন اُدْعُوْا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَ خُفْيَةً اِنَّهُ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْن অর্থ্যাৎ তোমরা তোমাদের প্রভুকে কাকুতি-মিনতি অর্থ্যাৎ বিনয়ের সাথে এবং সংগোপনে আহবান কর।সুতারাং উক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় দোয়া করার সময় বিনয়,নম্রতা ও ভদ্রতা অবলম্বন করা।

হাদিসের আলোকে দোয়া’র গুরুত্ব

দোয়ার গুরুত্ব প্রসঙ্গে পবিত্র হাদিস শরীফে ব্যপক ভাবে বর্ণিত হয়েছে

রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন اَلدُّعَاءُ مُخُّ الْعِبَادَة দোয়া ইবাদতের মগজ বা মূল। তাই সকলের উচিত সকল ইবাদত করে আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে,বিনয়ের সাথে দোয়া করা। কারণ আল্লাহর নিকট দোয়া হচ্ছে অধিক প্রিয় এবং মর্যাদাবান। এ প্রসঙ্গে রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন لَيْسَ شَيْءٌ اَكْرَمُ عَلَى اللّٰهِ مِنَ الدُّعَاء আল্লাহর নিকট দোয়ার চেয়ে অন্য কিছু মর্যাদাবান নয়। তাহলে বুঝা যায় দোয়া কতটুকু মর্যাদাপূর্ণ। পক্ষান্তরে যারা দোয়া করে না আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি রাগান্বিত হন। রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন ِمَنْ لَمْ يَدْعُ اللّٰهَ سُبْحَانَهُ، غَضِبَ عَلَيْه যারা আল্লাহর নিকট দোয়া করে না, আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি রাগান্বিত হন। তাই আমাদের আল্লাহর নিকট বেশি বেশি দোয়া করা উচিত।কারন এই দোয়া হচ্ছে মুমিনের হাতিয়ার। রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন َتَدْعُوْنَ اللّٰهَ فِى لَيْلَكُمْ وَ نَهَارَكُمْ فَاِنَّ الدُّعَاء سِلَاحُ الْمُؤْمِن -তোমরা আল্লাহর নিকট দিবা-রাত্রি দোয়া কর,কেননা দোয়া হলো মু’মিনের হাতিয়ার। হাতিয়ার যেমনিভাবে সকল কাজে ব্যবহৃত হয় তেমনিভাবে দোয়া সকল ইবাদতের জন্য করা উচিত। দোয়া মাধ্যমে মানুষের তাকদির পরিবর্তন হয়।রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন ِاَكْثِرْ مِنَ الدُّعَاءِ فَاِنَّ الدُّعَاءَ يَرُدُّ الْقَضَاءَ الْمُبْرَم – তোমরা আল্লাহর নিকট বেশি বেশি দোয়া কর,কেননা দোয়ার দ্বারা তাকদিরে মুবরাম তথা চুড়ান্ত তাকদির পরিবর্তন হয়। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি দোয়া করা। দোয়া মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য রহমতের দরজা সমূহকে উম্মুক্ত করে দেন।

দোয়া’য় হাত উত্তোলন তথা দোয়ার আদব প্রসঙ্গ

দোয়া করার সময় দোয়া কবুল হওয়ার উপর পূর্ণ আস্থা থাকতে হবে এবং নিশ্চিত বিশ্বাস রাখতে হবে এবং বিনয়ের সাথে দোয়া করতে হবে। কেননা রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যখন দোয়া করবে, তখন পূর্ন দৃঢ়তার সাথে প্রার্থনা করবে। দোয়া করার সময় হাত উঠানো প্রয়োজন। কারন হাত তোলার সময় কথা ও কাজে মিল থাকে এবং চুড়ান্ত বিনয় বিদ্যমান থাকে।

দোয়া করার সময় হাত তোলা সুন্নাহ সম্মত এবং বরকতময় আমল। কেননা এ প্রসঙ্গে হযরত ওমর (রাদ্বিয়ালল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন ّكَانَ رَسُوْلُ اللّٰهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْه وَسَلُّمَ اِذَا رَفَعَ يَدَيْهِ فِى الدُّعَاءِ لَمْ يُحِطُّهُمَا حَتّٰى يَمْسَحَ بِهِمَا وَجْهَه যখন রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দোয়ার মধ্যে হাত উত্তোলন করতেন তখন তার হস্তদ্বয় তার চেহারা মোবারকে মাসেহ করা ব্যতিত নামাতেন না।[তিরমিয়ী,পৃ- ৪৮৮] রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর এই হাদিসে ফে’লি দ্বারা বুঝা যায় তিনি দোয়ার সময় হাত উত্তোলন করতেন এবং দোয়া শেষে মুখ মাসেহ করতেন। দোয়া সময় তো হাত তুলা সুন্নাহ সম্মত এবং কিভাবে হাত তুলতে হবে, কী পদ্বতি অবলম্বন করতে হবে তা ও বর্ণনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে

হযরত আব্বাস (রাদ্বিয়ালল্লাহু আনহু) নবী করিম (সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেন ُاِذَا سَاَلْتُمْ اللهَ فَاسْءَلُوْه بِبُطُوْنِ اَكْفِكُمْ وَلاَ تَسْءَلُوْهُ بِظُهُوْرِهَا وَاَسْحَابِهَا وُجُوْهَكُم যখন তোমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, তখন তোমরা তোমাদের হাতের ভিতর দিক তথা হাতের তালুর দিক দিয়ে প্রার্থনা করবে,হাতের বাহিরের অংশ তথা হাতের পিঠ দিয়ে দোয়া করবে না এবং হাত দ্বারা মুখমন্ডল মাছেহ করে নিবে।[মাজমাউয যাওয়ায়েদ,খন্ড-১০,পৃ-১৪৯]

তাহলে বুঝা যায় দোয়া করার সময় হাত উত্তোলন করা সুন্নাহ সম্মত এবং বিনয়ের অন্যতম মাধ্যম। কারন আমরা দেখি যখন কোন ভিক্ষুক কোন কিছু চায়, তখন সে বান্দার নিকট হাত পাতে, কারন তার কিছু পাওয়ার মাধ্যম হলো এই হাত উত্তোলন করা,তা না হলে কেউ তাকে কোন কিছু প্রদান করতো না। সাধারনত কোন কিছু পাওয়ার জন্য হাত দিতে হয়, হাতের ব্যবহার ছাড়া কোন কিছু নেওয়া যায় না,অনুরুপ বান্দা আল্লাহর দরবারে ফকির তুল্য,কোন কিছু চাওয়ার জন্য হাত উত্তোলন করতে হবে।কারন এটিই হচ্ছে বাস্তবতা। হাত উত্তোলন প্রসঙ্গে আরো বর্ণিত হয়েছে,

হযরত আনাস (রাদ্বিয়ালল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-كاَنَ رسول الله صلى الله عليه وسلم يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِى الدُّعَاءِ حَتّٰى يُرٰى بَيَاضُ اِبْطَيْه রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দোয়াতে এমন ভাবে হাত উত্তোলন করতেন তার বগলের শুভ্রতা পর্যন্ত দেখা যেত। [মিশকাত শরীফ,পৃ-১৯৬,হাদিস নং-২১৩৯] সুতারাং বুঝা যায় দোয়া করার সময় হাত উত্তোলন করা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ।

আর এই দোয়া কবুল হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো দোয়ার আগে আল্লাহর প্রশংসা করা এবং রাসুল(সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উপর বেশি হারে দুরুদ শরীফ পাঠ করা। কেননা হযরত আলী (রাদ্বিয়ালল্লাহু আনহু) বলেন-ُّكُل ُدُعَاءِ مَحْجُوْبٌ حَتّٰى يُصَلِّي عَلٰى مُحَمَّد صَلّٰى اللّٰه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاٰلِ مُحَمَّد যতক্ষণ পর্যন্ত মুহাম্মদ (সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও তার পরিবারের উপর দুরুদ পড়বেনা ততক্ষণ পর্যন্ত দোয়া কবুল হওয়া থেকে বঞ্চিত থাকবে।[মাযমাউয যাওয়ায়েদ,খন্ড-১০,পৃ-১৫৫]

তাই আমাদের উচিত আল্লাহর দরবারে বেশি দোয়া করা এবং ক্ষমা চাওয়া এবং দোয়ার সময় হাত উত্তোলন করে সুন্নাহ’র অনুসরন করা এবং বিনয়ের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে কোন কিছু প্রাথর্না করা।

লিখক

মুহাম্মদ মোশারফ হোসাইন